সীমান্তে রক্ত: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক অমীমাংসিত অধ্যায়

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৫ এ ১:২৯:১০ PM

লেখক: আশিক খান

সীমান্তে রক্ত: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক অমীমাংসিত অধ্যায়

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড শুধু এই দুই দেশের মধ্যে নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্ত হত্যা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ নয়, এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের স্থিতিশীলতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম স্থলসীমান্ত। এই সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন পণ্য, মানুষ এবং গবাদিপশুর অবৈধ পাচারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলে। সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এবং বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নিয়োজিত। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিহত হওয়ার ঘটনা একাধিকবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুসারে, গত দুই দশকে প্রায় ১,২০০ বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হয়েছেন। সীমান্তে এত এত সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যাকান্ডের পেছনের কারণগুলো আসলে কি কি? প্রথমত অবৈধ পথে পাচার ও চোরাচালান। গবাদি পশু, মাদকদ্রব্য, এবং অন্যান্য পণ্যের পাচার সীমান্ত হত্যার অন্যতম কারণ।
দ্বিতীয়ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের কঠোর নীতি। ভারতীয় বিএসএফের "শুট অন সাইট" নীতি বাংলাদেশিদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
এবং তৃতীয়ত বলতে গেলে দ্বিপাক্ষিক সমন্বয়ের অভাব। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা বরাবরই খুব কম পরিলক্ষিত হয় এবং প্রতিবেশি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের যে কর্তৃত্বমূলক মনোভাব তা সমন্বয়ের এই পথকে বারবার রুদ্ধ করেছে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং জাতিসংঘের নির্দেশিকার পরিপন্থী। কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে হত্যা করা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। একইসাথে এর প্রবল বিরুপ প্রভাব পড়ছে দুই দেশের কুটনীতিতে এমনকি মানুষের মধ্যেও। একইসাথে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনাও। সীমান্ত হত্যার কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে জটিল করে তোলে। সেইসাথে তৈরি করছে আস্থার সংকট। দুই দেশের মধ্যে আস্থা তৈরির প্রচেষ্টা সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, ভারত তাদের উদ্বেগকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। আবার উন্নয়ন প্রকল্পও ব্যাপকভাবে ব্যহত হয়ে। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর সীমান্ত হত্যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনগণের বিরূপ মনোভাবের কারণে সঙ্গত কারণেই অনেক সময় সরকারও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সতর্ক অবস্থান নেয়। এখন সময় এসেছে। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পর বাংলাদেশের মানুষের ভিতরেও এসেছে বিপ্লবী চেতনা, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। মানুষ এখন আর কারও শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে চায় না। তাই সীমান্ত হত্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কার্যকর সমাধান আসতে পারে কয়েকভাবে। প্রথমত, কুটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সীমান্ত হত্যাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা গঠন করে এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব। দ্বিতীয়ত সীমান্তে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রাণঘাতি অস্ত্রের পরিবর্তে অ-প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করা যেতে পারে। সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের পরিবর্তে রাবার বুলেট বা স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোনের মাধ্যমে সীমান্ত নজরদারি বাড়ানো সম্ভব। তৃতীয়ত জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সীমান্ত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ করা সম্ভব। সীমান্ত এলাকার বিকাশে অর্থনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলে পাচারের প্রবণতা কমে যাবে। এবং সর্বশেষ, দুই বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত সংলাপ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। এছাড়াও মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সীমান্ত হত্যার বিষয়ে আরও সোচ্চার হতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে ধরে দুই দেশকে সমাধানে বাধ্য করা যেতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা একটি জটিল ও সংবেদনশীল সমস্যা, যা উভয় দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। সীমান্তে রক্ত ঝরানো বন্ধ করতে হলে উভয় দেশকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এই ইস্যুটি শুধু দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতার বিষয় নয়, এটি মানবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ এবং ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে।

international