শিরোনাম :বিষণ্ণতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রজন্মের তরুণদের আখ্যান ।

শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ এ ১০:০২:০৩ AM

লেখক: জান্নাতুল নাঈম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বিভাগ : ইংরেজি , ইমেইল :nayemnadia2004@gmail.com

শিরোনাম :বিষণ্ণতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রজন্মের তরুণদের আখ্যান ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ব্যক্তিমাত্রেই লক্ষ করে থাকবেন চলমান তরুণ প্রজন্মের মনোবৃত্তি ও চিন্তাজগতের অন্দরমহলের অন্তর্দৃশ্য। সমাজ থেকে ছিটকে পড়া এই প্রজন্ম বিশ্বাস করে একটি আবদ্ধ কাঠামোতে যেখানে কিনা তার জগৎ নিবদ্ধ ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম-ফ্রেন্ড আর ফলোয়ারে। যে জগতকে তারা হাতিয়ার বানিয়েছে অস্ফুট কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণে। এই তরুণ সমাজ নিজেদের প্রাত্যহিকতার অংশ হিসেবে বেছে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। পরিবার আর সামাজিক কাঠামোতে তীব্র অনাস্থা পোষণ করে দৈনন্দিন জীবনকে ফুটিয়ে তুলছে সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যে যুবক বা যুবতীটি পরিবার আর সমাজে দারুণ প্রাণোচ্ছল বলে পরিচিত তাকেই ঠিক বিপরীতভাবে দেখা যাবে তার বিশ্বাস আর ভরসার জায়গায়- সেটা হতে পারে ফেসবুক, হতে পারে ইন্সটাগ্রাম কিংবা টুইটার। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি শতকরা ৯০ শতাংশ তরুণ নিদারুণভাবে হতাশ নিজেদের যাপিত জীবন আর জগৎ নিয়ে। বেসামাল ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনচর্যা ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে ফেলছে যাপিত জীবনকে। তাই তারা সামলাতে পারছে না প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, ক্যারিয়ার অথবা বিবাহিত জীবন। মানসিক বৈকল্যজনিত একটি প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে বিষণ্ণতা। বিষণ্ণতা এই প্রজন্মের নিত্যসঙ্গী। মানসিক অবসাদজনিত বিষণ্ণতা জন্ম দিচ্ছে শারীরিক অবসন্নতার ; ফলাফলস্বরুপ জীবন আরো বিষিয়ে উঠছে। একটা চক্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এই প্রজন্ম। সীমিত চিন্তার জগৎ নিয়ে পৃথিবীর বিশালতায় অবগাহন করার ইচ্ছা আর স্পর্ধা দুটোই তারা হারিয়েছে৷ পরিণতিতে বাড়ছে নানা সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি আত্মহত্যার প্রবণতা। এই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা মানবসম্পদকে করে দিচ্ছে অকার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বজুড়ে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৯) দেখা গেছে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ভোগে বিষণ্ণতায়, ৪ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ বেশি যেটা বিষণ্ণতার অন্যতম একটি নিয়ামক। (সূত্র- প্রথম আলো) আরেকটি রিপোর্টে উঠে এসেছে বিষণ্ণতায় ভোগার মাত্রার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে নারীরা পুরুষদের থেকে এগিয়ে আছেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে নিস্ক্রিয় থাকা বিষণ্ণতার ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক জরিপে উঠে এসেছে যে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করা তরুণদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বিভিন্ন মাত্রায় বিষণ্ণতায় ভুগছে। এ তো গেল প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীদের হিসাব। কিন্তু ওই ক্রান্তিকালে তরুণ সমাজের যে বিশাল অংশকে ঘরবন্দি হয়ে কাটাতে হয়েছে তাদের মানসিক পীড়নের কথা তো কোনো জরিপে উঠে আসেনি! তরুণদের এই অংশ আরো ব্যাপকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং যথারীতি হচ্ছে। আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করতে না পারার ক্ষোভ, কষ্ট আর মানসিক উৎপীড়নের ভোগান্তি কোনো সমীক্ষায় উঠে আসবে না কিন্তু একটা গোটা প্রজন্মকে এর দায়ভার নিতে হচ্ছে। বিষণ্ণতা কোনো একক কারণে উদ্ভূত হয় না, পারিপার্শ্বিক অসংখ্য সামাজিক ও জাতীয় সমস্যা এর পেছনে দায়ী। অবাধ বিশ্বায়নের ফলে বৈশ্বিক সমস্যাগুলো পরিণত হয় জাতীয়, ধর্মীয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সমস্যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইজরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আজ আর শুধু আন্তঃরাষ্ট্রীয় গোলযোগে থেমে থাকেনি। বিশ্বের প্রতিটি সংবেদনশীল রাষ্ট্র আজ একাত্ম বোধ করছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি। প্রতিটি মুসলমান তার আরেক ভাইয়ের প্রতি এহেন নির্যাতনে তীব্র মানসিক সংকটে ভুগছে। পৃথিবীর যাবতীয় রিপোর্ট, সমীক্ষা শুধু একটি অবস্থার ভয়াবহতাকে তুলেই ধরতে পারবে, কোনো স্থায়ী ও কার্যকরী সমাধানে পৌঁছুতে পারবে না। সৃষ্টির আদিকাল থেকে বিষণ্ণতার উপস্থিতি থাকলেও খুব বেশি দিন হয়নি এটি একটি রোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সমস্ত নিরাশার মধ্যেও কিছুটা স্বস্তিদায়ক বিষয় হচ্ছে গবেষক, মনোচিকিৎসকগণ, রাষ্ট্র এমনকি স্বয়ং ভুক্তভোগী সমস্যাটিকে বিশেষ বিবেচনায় আনছেন। এই প্রজন্ম সমস্যার নিয়ামক হিসেবে যেমন কাজ করে তেমনি এটি থেকে উত্তরণের ব্যাপারেও বিশেষভাবে সচেতন। তবে সমস্যার গুরুত্বের তুলনায় সচেতনতার মাত্রা বৃদ্ধি করাও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাইকে এই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। আগামী ২০২৬ সালকে ঘোষণা করা হোক বিষণ্ণতা থেকে উত্তরণের বর্ষ হিসেবে।

national